Thursday, May 2, 2013

লাশের জন্য ক্লান্তিহীন অপেক্ষা


লাশের জন্য ক্লান্তিহীন অপেক্ষা

প্রিয় মানুষটি জীবিত ফিরে আসবেন- এ আশা আগেই ছেড়ে দিয়েছেন, তবুও স্বজনেরা দিনরাত ক্লান্তিহীন অপেক্ষা করছেন। জীবিত মানুষটির জন্য নয় তার মৃতদেহের জন্য। রানা প্লাজা ধসের নবম দিনে অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে গিয়ে দেখা গেছে হাজারো স্বজনকে। আহার নিদ্রা ভুলে গেছেন তারা। ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি মৃতদেহ উদ্ধার করে স্কুল মাঠে আনার সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে তারা ছুটছেন সেখানে। যখনই দেখা যায় মৃতদেহটি তাদের কারো নয়, আশাহত হচ্ছেন। আবার লাশ আসলে আবারো ছুটছেন তারা। কেউ বাবা-মা, কেউ সন্তান, কেউ স্বামীর খোঁজে রয়েছেন। হাতে নিখোঁজ মানুষটির ছবি। জীবিকা নির্বাহ করতে শ্রমিকরা বেওয়ারিশ হবে- এটা স্বজনহারারা মেনে নিতে পারছেন না।স্বেচ্ছাসেবকরা তিনবেলা খাবার সরবরাহ করছেন। মাঠে ধূলোবালুর মধ্যে দিনরাত কাটছে তাদের।

গত দুই দিন ধরে উদ্ধারকৃত লাশগুলো শনাক্ত করার উপায় নেই। পচে গেছে লাশ। লাশ পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৩৪ জন গার্মেন্টস শ্রমিকের লাশ আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম আজিমপুর ও জুরাইন কবরস্থানে দাফন করেছে। নেত্রকোনা থেকে কাঁচামাল বিক্রেতা কামাল হোসেন এসেছেন তার মেয়ে পলি আকতারের সন্ধানে। গত সাতদিন ধরে তিনি এ মাঠে রয়েছেন। পলির সন্ধান পাননি। পলির সঙ্গে সেনাবাহিনীর এক সদস্যের বিয়ে প্রায় চূড়ান্ত ছিল। একথা বলতে বলতে কামাল হোসেন কাঁদছেন। নিখোঁজ গার্মেন্টস কর্মী জয়ার (১৭) সন্ধানে দিনাজপুর ঘোড়াঘাট থেকে এসেছেন তার বড় ভাই জায়েদুল ইসলাম। তিন বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট জয়া। সেই অতি আদরের ছোট বোনের জন্য ৭ দিন ধরে অধরচন্দ্র স্কুল মাঠে দিনরাত কাটাচ্ছেন জায়েদুল। বোনের লাশ পাননি।

রোকেয়া আক্তারের (৩০) খোঁজে এসেছেন তার কন্যা সুমি আক্তার (১৮)। মায়ের জন্য ৬ দিন ধরে মাঠে বসে আছেন। লাশ আসলে দৌড়ে যায় সুমি। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত মায়ের সন্ধান পায়নি। ফরিদপুর আলফাডাঙ্গা উপজেলায় তাদের বাড়ি। রানা প্লাজার ৪র্থ তলার গার্মেন্টস শ্রমিক মমতাজ বেগমের (৩০) লাশের সন্ধানে এসেছে তার পুত্র মুন্না (১৪)। মায়ের পরনে সাদা কাপড় ও পায়ে দাগ রয়েছে। মৃতদেহ আসলে মুন্না ছুটে যায়। মিলিয়ে দেখে শরীরে থাকা কাপড়ের সঙ্গে। দেখার চেষ্টা করে পায়ে আছে কীনা দাগ। ৬ দিন ধরে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। মিলছে না মায়ের লাশের দেখা। বরিশাল বেতাগী উপজেলার ভোলানাথপুর গ্রামের বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম এসেছেন ছেলে আল-আমিনের (২৫) সন্ধানে। ৫ দিন ধরে তিনি রয়েছেন স্কুল মাঠে। ২ ছেলে ১ মেয়ের মধ্যে আল-আমিন সকলের ছোট। ৫ মাস আগে বিয়ে হয়েছে তার। সিঙ্গাইর উপজেলার চরগ্লোরা এলাকা থেকে মিনজু মিয়া এসেছেন তার স্ত্রী রোজিনার খোঁজে। ৮ দিন ধরে তিনি স্ত্রীর লাশের অপেক্ষায়। সঙ্গে তাদের চার বছেরের ছেলে। দিন রাত মা মা বলে কাঁদছে ছেলেটি।

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার উপাধিপুর গ্রামের বৃদ্ধ নূরজাহান বেগমের দুই কন্যা সেলিনা বেগম (১৯) ও আকলিমা বেগম (১৭) রানা প্লাজার সাত তলায় কাজ করতেন তারা। আহত আকলিমাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে একদিন পর উদ্ধার করা হয়। আকলিমা বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বোনের ছবি হাতে নিয়ে মা নূরজাহানের সঙ্গে আকলিমা স্কুলে মাঠে। দিনরাত ছবির দিকে তাকিয়ে শুধু কাঁদছেন মা-মেয়ে। শ্রমিক শহিদুল ইসলামের (২৪) খোঁজে তার মা জরিনা খাতুন ৮ দিন ধরে মাঠে অপেক্ষা করছেন। 

৫৬ জন বেওয়ারিশ

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে ৫৬ জনের পরিচয় মেলেনি। ৩৪ জনের লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে এবং স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয় ২২টি। গত বুধবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গ থেকে ১৯ জনের লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৫টি মৃতদেহ মর্গে রয়েছে। এদের মধ্যে ৯ জনের পুরো মৃতদেহ রয়েছে, ৬ জনের লাশের কারো হাত কারো পা, কারো দেহের কিছু অংশ অবশিষ্ট রয়েছে। একই দিনে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গ থেকে ১৪টি লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৬টি লাশ আত্মীয়-স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কাফন পরানোর সময় এক মহিলার শরীরে মোবাইল দেখতে পাওয়া যায়। পরে ঐ ফোনে ফোন করা হলে নওগাঁও থেকে তাঁর স্বজনরা এসে তার লাশ নিয়ে যায়। জুরাইন কবরস্থানে দাফনের সময় উপস্থিত একজন পরনের কাপর থেকে লাশ শনাক্ত করে। এ লাশ ও স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ১ ছেলে ও এক মহিলা কর্মী এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ১৫টি মৃতদেহ রয়েছে।

0 comments:

Post a Comment